দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়বস্তু নিয়েই থাকছে আমাদের আজকের মূল আলোচনা। সাথেই আপনাদের জন্য আরও থাকছে, দোভাষী পুঁথির উল্লেখযোগ্য কবি কারা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সমূহ। তাই আমাদের আজকের পোস্টটি অবশ্যই সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়ুন যেন দোভাষী পুঁথি সাহিত্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য পেতে পারেন।
দোভাষী-পুঁথি-সাহিত্যের-উদ্ভব-ও-বিকাশ-সম্পর্কে-বিস্তারিত-জানুন
পুথি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি মূলত আঠারো ও উনিশ শতক পর্যন্ত রচিত হয়। পুথির সাহিত্য সাধারণত ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে গঠিত, যা সেই সময়ের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনোভাবকে প্রতিফলিত করে। তাই আজকের পোস্টে দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সেই বিষয় সম্পর্কে বিশদভাবে সকল তথ্য আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করব। আশা করছি আপনারা ধৈর্য সহকারে আজকের পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়বেন।

ভূমিকা

পুথি সাহিত্য এবং দোভাষী পুঁথি সাহিত্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ, যা অতীতে প্রতিটি ঘরে প্রচলিত ছিল। সন্ধ্যা হলে কুপী জ্বালিয়ে পুথি পড়া শুরু হতো, এবং শর্টে সকলেই পুথি-পাঠককে ঘিরে মনোযোগ সহকারে শুনতেন। তাই আজকের পোষ্টের মাধ্যমে আমরা জানবো, বাংলার পুথি সহ দোভাষী পুঁথি বলতে কী বোঝায়, দোভাষী পুঁথির উল্লেখযোগ্য কবি কারা, বাংলা পুঁথি সংগ্রহের ইতিহাস, পুঁথি সাহিত্যের আদি কবি কে, দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ, পুরানো বাংলা হরফে লেখা পুঁথি সম্পর্কে তথ্য সে বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত সকল তথ্য সমূহ।

বাংলার পুথি

পুথি হল একটি হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ। যখন মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হইয়েছিল না তখন প্রায় সব কিছু হাতেই লেখা হতো। একটি গ্রন্থ রচিত হলে, তার গুরুত্ব ও চাহিদা অনুযায়ী একাধিক অনুলিপি তৈরি করা হতো। বর্তমানে পুথিকে 'পান্ডুলিপি' বলা হয়। 'পুথি' শব্দটি মূলত সংস্কৃত 'পুস্তক' থেকে উদ্ভূত হলেও প্রাকৃত, হিন্দি, অসমীয়া ও ফরাসি ভাষার শব্দগুলোর প্রভাবও রয়েছে।

প্রাচীন হস্তলিখিত পুথিগুলো লোকায়ত উদ্যোগের পরিচয় বহন করে, যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠায় মার্জিন রাখা হতো যেন লেখাগুলো সুরক্ষিত থাকে। সাধারণ পুথিগুলো বাম থেকে ডানে লেখা হত, जबकि ইসলামী পুথিগুলো ডানে বামে। পৃষ্ঠাগুলোতে সুম তারা সন্নিবেশ করানোর নিপুণ পদ্ধতি প্রমাণ করে শিল্পের এক অপরূপ স্বাক্ষর।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন বাংলার জনপদ কয়টি 

প্রাচীন পুথির যে সূচিপত্রের রীতি ছিল, 'পদ্মাবতী' পুথিতে এ ধরনের সূচীর উদাহরণ মিলে। তৎকালীন সময়ে পুথি লেখার জন্য ব্যবহৃত উপাদানগুলো ছিল চামড়া, ভূর্জপত্র, তালপাতা ইত্যাদি। এগুলোকে পানি ভিজিয়ে, সেদ্ধ করে ও রোদে শুকিয়ে লেখা উপযোগী করা হতো। ফলে এগুলোর রঙ সাধারণত পান্ডু বা ধূসর হয়ে যেত এবং এতে পোকা লাগত না।

কিন্তু এসব প্রাকৃতিক উপাদানের অভাব ও সীমাবদ্ধতার কারণে অবশেষে তুলট কাগজ আবিষ্কার হয়, যা শন, তুলাসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি করা হতো। তুলট কাগজের আকারও বড় হতো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট বা বড় পত্র তৈরি করা সম্ভব ছিল। মূলত দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে আলোচনার পূর্বে বাংলার পুঁথি কি তা জেনে নেয়া উত্তম তাই প্রথমেই এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হলো।

দোভাষী পুঁথি বলতে কী বোঝায়

"দোভাষী পুঁথি" হলো এমন পুঁথি যা বিভিন্ন ভাষার শব্দ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এটি শুধুমাত্র দুটি ভাষার সংমিশ্রণ নয়, বরং বাংলা, হিন্দি, ফারসি, আরবি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার মিশ্রণে রচিত পুঁথি। পুথি সাহিত্যের ভাষা ও শব্দসম্ভারের কারণে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন নামকরণ করেছেন। রেভারেন্ড জেমস লং একে ‘মুসলমানী বাংলা’ বলেন।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন বাংলার জনপদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা

আবার এই ভাষায় রচিত সাহিত্যকে ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কলকাতার বটতলার ছাপাখানার মাধ্যমে এ সাহিত্য প্রচার লাভ করায়, একে ‘বটতলার পুথি’ নামেও ডাকা হয়। গবেষকগণ এর ভাষা ও বাক্যরীতি অনুযায়ী প্রথমে এগুলিকে দোভাষী পুথি এবং পরে ‘মিশ্র ভাষারীতির কাব্য’ হিসেবে অভিহিত করেন। পুথি সাহিত্যকে বিষয় ও রস অনুযায়ী ছয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
  • রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য
  • জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য
  • নবী-আউলিয়ার জীবনীকাব্য
  • লৌকিক পীর পাঁচালি
  • ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম, রীতিনীতি বিষয়ক শাস্ত্রকাব্য
  • সমকালের ঘটনাশ্রিত কাব্য।

দোভাষী পুঁথির উল্লেখযোগ্য কবি কারা

পুথি সাহিত্য হলো একটি বিশেষ শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য, যা আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে। এর সমাজিক পরিপ্রেক্ষিত আঠারো থেকে উনিশ শতককালীন এবং সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের লেখক ও পাঠক উভয়েই ছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সাহিত্য রচনায় ৩২% বিদেশি শব্দ ব্যবহার হয়েছে।

তাছাড়া দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ এর ক্ষেত্রেও যদি লক্ষ করা হয় তাহলে একই রকম অবস্থা পাওয়া যাবে। হুগলি, হাওড়া, কলকাতা এবং ২৪ পরগনার মুসলমানদের কথ্যভাষা এ সাহিত্যের মূল উৎস বলে ধরা হয়। দোভাষী পুথিকারদের সাধারনত 'শায়ের' বলা হয়, যা আরবি শব্দ এবং এর অর্থ কবি। সৈয়দ হামজা আমীর হামজা তাঁর গ্রন্থের শুরুতে 'শায়েরি পুঁথি' উল্লেখ করেছেন। বিষয়বস্তু স্পষ্টতা বজায় রাখতে 'শায়েরি পুঁথি' নামটি গ্রহণ করা যেতে পারে।

সাধারণ বাংলা গ্রন্থের মতো পুথি সাহিত্যের পাঠও বাম দিক থেকে কিন্তু তা ডান দিক থেকে ছাপা হয়, যা আরবি ও ফারসি সাহিত্যের রীতি। এই সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে রচিত অলঙ্কারবর্জিত সরল ভাষা। গরীবুল্লাহর প্রথম কাব্য 'ইউসুফ-জুলেখা' সাধু বাংলায় রচিত এবং তিনি মিশ্র ভাষারীতিতে 'সোনাভান', 'সত্যপীরের পুথি', 'জঙ্গনামা' ও 'আমীর হামজা' রচনা করেছেন।

'আমীর হামজা' সম্ভবত তাঁর পরিণত বয়সের লেখা, যা সৈয়দ হামজা ১৭৯৫ সালে অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ করেন। সৈয়দ হামজার প্রথম কাব্য 'মধুমালতী' সাধু বাংলায় এবং পরে তিনি 'জৈগুনের পুঁথি' (১৭৯৮) ও 'হাতেম তাই' (১৮০৪) মিশ্র ভাষায় রচনা করেন। পুথি সাহিত্যের শব্দসম্ভার ও ভাষারীতি অবশ্য পূর্ববর্তী কাব্যে ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে নতুন ছিল না, কারণ ইতিহাসে কিছু হিন্দু কবিরাও মুসলিম প্রসঙ্গ সাক্ষাৎকারে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তুর্কি বিজয়ের পর ফারসি রাজভাষা হিসেবে গৃহীত হলে, উভয় সম্প্রদায় ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ প্রবেশ করে।

বাংলা পুঁথি সংগ্রহের ইতিহাস

ষোলো শতকের মুগল আমলে বাংলায় মুসলমানদের আগমন বৃদ্ধি পায়, ফলে দিল্লির সঙ্গে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়। উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারগুলি মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও হাওড়ায় বসবাস গড়ে তোলে, যার ফলে বাংলায় উর্দু ও হিন্দির প্রভাব বাড়ে। ফারসির প্রভাবও উল্লেখযোগ্য, এবং ইউরোপীয় বণিক কোম্পানির কর্মচারীরাও এ ভাষা শিখত।

আঠারো শতকে, তথাগত ভাষার পরিস্থিতি লক্ষ করে হ্যালহেড উল্লেখ করেন যে, যারা বাংলা ক্রিয়ার সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দ মিশ্রিত করে কথা বলেন, তারাই প্রকৃত বাংলাভাষী। এই ধরনের ভাষাকে 'কাজের ভাষা' বা 'ব্যবহারিক বাংলা' নামে অভিহিত করেছেন সুকুমার সেন, এবং ভারতচন্দ্র একে 'যাবনী মিশাল' ভাষা হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে বাংলা পুথি সংগ্রহের ইতিহাস এর মধ্যে   দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ এর ক্ষেত্রেও এসব ইতিহাস পাওয়া যাবে।

মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কথ্যভাষা পুথি সাহিত্যের ভাষার উৎস, যা একে কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা বলা যাবেনা। আরবি-ফারসির মিশ্রণের কারণে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের কাছে এই ভাষা বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের পটভূমির মধ্যে কবিওয়ালা এবং শায়েরের উৎপত্তি ঘটে।

১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘলশক্তির পতন শুরু হয় এবং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। সেই সময়, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, বরং ভাব, ভাষা, রীতি ও রুচির দিক থেকে অবনতি ঘটে।

শাসক শ্রেণির দুর্বলতা এবং নেতৃত্বের অভাবের ফলে সমাজে নৈরাজ্য ও স্বৈরাচার বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মহৎ সাহিত্য রচিত হয়নি এবং পূর্ববর্তী রস, রুচি ও আদর্শের দিক থেকে ক্ষয় সাধিত হয়। এই অবস্থায় হিন্দু সমাজে কবিগানের প্রসার ঘটে এবং মুসলমান সমাজে শায়েররা অলৌকিকতা নিয়ে দোভাষী পুঁথিসাহিত্য রচনা করেন, যা জনগণের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

পুঁথি সাহিত্যের আদি কবি কে

পুথি (বা পুঁথি) শব্দটির উৎপত্তি ‘পুস্তিকা’ থেকে, তবে পুথি সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ অর্থ ধারণ করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ সময়ে রচিত বিশেষ ধরনের সাহিত্যকে পুথি সাহিত্য বলা হয়। হুগলির কবি ফকির গরীবুল্লাহ (১৬৮০-১৭৭০) আমীর হামজা রচনা করে এই কাব্যধারার সূচনা করেন, যা আরবি ইতিহাস ও পুরাণ মিশ্রিত কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়।

মধ্যযুগে পাঁচশ বছরের বাংলা সাহিত্য ঐতিহ্যের সাথে এই কাব্যের ভাষার মিল নেই, কারণ এটি বাংলা, আরবি ও ফারসি শব্দের মিশ্রণে রচিত। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই কাব্যে ৩২% বিদেশি শব্দের উপস্থিতি উল্লেখ করেছেন। হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের কথ্যভাষা এ কাব্যের ভাষার উৎস।

গরীবুল্লাহ এবং তাঁর শিষ্য সৈয়দ হামজা এ ভাষায় আরও কিছু কাব্য রচনা করেন। পরে অনেক মুসলমান কবি এই ধরনের কাব্য রচনা করতে শুরু করেন। এর পাঠক ছিল সর্বস্তরের মুসলমান, কিন্তু নিম্নবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ

১৭৬০ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ ধরনের কাব্য রচিত হয়, যা পুথি সাহিত্য নামে পরিচিত। এই কাব্যগুলো বাংলা হিন্দি তুর্কি এবং আরবি - ফারসি শব্দের মিশ্রণে গঠিত এবং এতে অলৌকিকতা বীরত্ব বা প্রেমের কাহিনীর বর্ণনা থাকে। এ ধরনের কাব্য রচনা সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সা এর বলা হয়। মধ্যযুগের শেষ দিক থেকে শুরু হলেও আধুনিক যুগেও পুথি সাহিত্য প্রভাবশালী ছিল।

পুথি সাহিত্য নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ১৮৫৫ সালে রেফারেন্ট জে. লং "মুসলমান বাংলা সাহিত্য" এবং "মুসলমানি বাংলা" বলে উল্লেখ করেছিলেন। কলকাতার সস্তা ছাপাখানায় মুদ্রিত হওয়ার কারণে এ ধরনের কাব্যকে "বটতলার পুঁথি" বলা হয়। তবে সুনীতি বাবু, সুকুমার সেন এবং দীনেশচন্দ্র সেন এটিকে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য বলে সম্বোধন করেছেন।

কিছু মানুষ মনে করেন আরবি - ফারসি শব্দের মিশ্রণের কারণে এ নামটি হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে এসব কাব্যে বাংলা, হিন্দি, তুর্কি, আরবি ও ফারসি শব্দ গুলি মিশ্রিত হয়েছে। মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের রচিত কাব্য গুলো তাদের বৃহৎ গঠন বিশেষ পরিশোধিত এবং সংস্কৃত মিশ্রিত ভাষার কারণে জনপ্রিয়তা হারায়। এর বিপরীতে দোভাষী পুঁথি গুলো সচ্ছন্দ সংক্ষিপ্ত সহজ ভাষা ও সাফল্যের গল্পের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ছাপাখানার অভ্যুদয়ের ফলে এবং প্রকাশকদের সহযোগিতায় এগুলো সহজলভ্য হয়। পুঁথি সাহিত্যের ভাষার বৈশিষ্ট্য গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো।
  • আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের ব্যবহার এই ভাষার শব্দগুলোতে বেশি ব্যবহার করা হয়।
  • আরবি-ফারসি শব্দের নাম ধাতুর ব্যবহার সমূহ এখানে বিশেষভাবে আরবি ও ফারসি শব্দের ধাতু (মূল শব্দ) ব্যবহৃত হয়।
  • হিন্দি ধাতুর প্রয়োগ এবং হিন্দি ধাতুও ব্যবহার করা হয়।
  • বাংলা শব্দের সাথে আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের অনুসর্গ ও উপসর্গ যুক্ত করা হয়।
  • ফারসি বহুবচনের ব্যবহার ফারসি ভাষার বহুবচন প্রয়োগ করা হয়।
  • পুংলিঙ্গে বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দের ব্যবহার: বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ পুংলিঙ্গে ব্যবহৃত হয়।
  • এই বৈশিষ্ট্যগুলো পুঁথি সাহিত্যের ভাষাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে।
সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উন্মোচনে যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের আগে, মোগল শাসনের শেষের দিকে, ইরান থেকে ধর্মনেতা ও পীর-ফকিরদের মাধ্যমে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। এ সময় ইরানী শিয়া সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ফারসি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। পীরদের কাছে দেব-দেবীর পরাজয় ও তাদের প্রতিষ্ঠার গল্প লেখা শুরু হয়, এবং ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদও করা হতে থাকে।

সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর বাংলাদেশে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা সংস্কৃতির বিকাশে বাধা প্রদান করে। ১৭৬০ থেকে ১৮৬০ সালকে "ক্রান্তিকাল" বলা হয়, কারণ এ সময় কোনো শক্তিশালী কবির প্রবৃদ্ধি ঘটে নি। ইংরেজ শাসনের কারণে উচ্চবিত্ত মুসলমানদের ক্ষমতা কমে যায়, এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়।

ইংরেজদের অত্যাচারে সমাজের স্বাস্থ্য হারাতে থাকে, আর সাধারণ কৃষকরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে গরীব এবং ভূমিহীন হয়ে পড়ে। মুসলমানরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সাহিত্য নির্মাণে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিপরীতে পুঁথি সাহিত্য অশিক্ষিত জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে।

পুঁথি সংরক্ষণ পদ্ধতি

প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাল থেকে আধুনিক যুগে পুথির গুরুত্ব ও সংরক্ষণ চেষ্টার ইতিহাস মেনে চলা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পুথিকে কেন্দ্র করে বহু গবেষণা ও সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে বিদেশি গবেষক এবং ইউরোপীয় নাগরিকদের দ্বারা। নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, যিনি বাংলা ব্যাকরণের প্রাথমিক লেখক, ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে ১২টি বাংলা পুথি সংগ্রহ করেন, যা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে জমা দেন।

এ সময়ের উল্লেখযোগ্য পুথিগুলোর মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, চ-ীমঙ্গল এবং কালিকামঙ্গল অন্তর্ভুক্ত। তার পর, চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৬ সালে ‘চ-ীমঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ পুথি সংগ্রহ করেন এবং ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে দান করেন। এরপর রিচার্ড জনসন ১৮০৭ সালে ১৪টি বাংলা পুথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রদান করেন।

উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগারও পুথি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে খ্রিষ্টান মিশনারীরা তিন হাজারেরও বেশি হাতলিখিত ও মুদ্রিত পুথি দান করেন। সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২১ সালে সংগৃহীত একটি তালিকায় ৫১টি বাংলা পুথি উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে ‘মনসার ভাসান’, চন্ডী, জৈমুনী ভারত, চৈতন্য মঙ্গল এবং চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সার্বিকভাবে, পুথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বোঝায় যে, আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ কিভাবে ইতিহাসের বৈচিত্রে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রচেষ্টা বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা ও বিশ্বাসের অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে।

লেখকের মন্তব্য

আশা করি আজকের পোষ্টের মাধ্যমে আপনারা সকলে দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছেন। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আপনাদের যদি কোন প্রশ্ন বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদের জানানোর থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন এবং আমাদের পোস্টটি শেয়ার করার মাধ্যমে আপনার পরিবার এবং পরিজনের সকলকে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যগুলো জানার সুযোগ করে দিন।
ধন্যবাদ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মাহ্ফুজ আইটি বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url